আমিষ জাতীয় খাদ্য বিপাকের ফলে দেহে নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্যপদার্থ সৃষ্টি হয়। যে প্রক্রিয়ায় এসব পদার্থ দেহ থেকে নিষ্কাশিত হয় তাকে রেচন বলে।রেচন প্রক্রিয়ায় নিষ্কাষিত বস্তুগুলোকে বলা হয় রেচন পদার্থ । রেচন পদার্থগুলো সাধারণত ক্ষারীয় হয় । রেচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী অঙ্গগুলোকে বলা হয় রেচন অঙ্গ ।
যকৃত
হৃৎপিত
বৃক্ক
ফুসফুস
বৃক্কঃ মানুষের উদর গহ্বরের পেছন অংশে, মেরুদন্ডের দুপাশে বক্ষপিঞ্জরের নিচে ও পৃষ্ঠপ্রাচীর সংলগ্ন হয়ে দুটি বৃক্ক (Kidney) যুক্ত থাকে। সাধারণত বাম বৃক্কটি ডান বৃক্কের চেয়ে সামান্য উপরে থাকে ।
বাহ্যিক গঠনঃ প্রতিটি বৃক্ক নিরেট, চাপা দেখতে অনেকটা শিম বীজের মতো এবং লালচে রংয়ের। একটি পরিণত বৃক্কের দৈর্ঘ্য ১০-১২ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ৫-৬ সেন্টিমিটার এবং স্থলত্ব ৩ দিক অবতল। অবতল অংশের ভাঁজকে হাইলাম (hilum) বলে। প্রত্যেকটির ওজন পুরুষে ১৫০-১৭০ গ্রাম এবং স্ত্রীলোকে ১৩০-১৫০ গ্রাম। এই হাইলামের মধ্য দিয়ে ইউরেটার ও রেনাল শিরা বহির্গত হয় এবং রেনাল ধমনি ও স্নায়ু বৃক্কে প্রবেশ করে। সমগ্র বৃক্ক ক্যাপসুল (capsule) নামক তন্তুময় যোজক টিস্যুর সুদৃঢ় আবরণে বেষ্টিত।
বৃক্কের অন্তর্গঠনঃ লম্বচ্ছেদে দেখা যায়, প্রতিটি বৃক্ক তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত, যথা-বাইরের কর্টেক্স (cortex), মাঝখানে অবস্থিত মেডুলা (medulla) এবং ভিতরে পেলভিস (pelvis)। পেলভিস হলো বৃক্ক অভ্যন্তরে বৃহৎ সংগ্রাহক স্থান, যা ইউরেটারের উপরের প্রসারিত অংশ থেকে গঠিত হয় এবং মেডুলার গঠনসমূহকে ইউরেটারের সাথে সংযুক্ত করে। মেডুলা ৮-১৮টি রেনাল পিরামিড (renal pyramid) নিয়ে গঠিত। রেনাল পিরামিড অনুদৈর্ঘ্যভাবে ডোরাকাটা এবং কৌণাকৃতি অঞ্চল। প্রতিটি পিরামিড শীর্ষ প্যাপিলায় শেষ হয়। প্যাপিলা হাইলামের দিকে নির্দেশিত। কর্টেক্স বৃক্কের সর্বাধিক বাইরের অংশ, এবং বহিঃস্থ কর্টিক্যাল (cortical) অঞ্চল ও অন্তঃস্থ জাক্সটেমেডুলারি (juxtamedulary) অঞ্চল নামক দুটি অঞ্চলে বিভক্ত। কর্টেক্স অঞ্চলে নেফ্রনের রেনাল করপাসল, প্রক্সিমাল প্যাচানো নালিকা অবস্থান করে।
বৃক্কের কাজঃ
* রক্ত থেকে প্রোটিন বিপাকে সৃষ্ট নাইট্রোজেন জাতীয় বর্জ্য অপসারণ করা।
* দেহে এবং রক্তে পানির ভারসাম্য রক্ষা করা।
* রক্তে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফেট এবং ক্লোরাইডসহ বিভিন্ন লবণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা। * রক্তে অম্ল ও ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করা।
* যথাযথ আয়নিক কম্পোজিশন বজায় রাখা।
* হরমোন (যথা-এরিথ্রোপোয়েটিন) নিঃসরণ করা।
* এনজাইম (যথা-রেনিন, Fennin) নিঃসরণ করা।
* রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা।
* দেহে প্রবিষ্ট প্রতিবিষ ও ভেষজ পদার্থসমূহকে দেহ থেকে অপসারণ করা।
মানুষের বৃক্কের সূক্ষ্ম গঠন বলত্ব নেফ্রনের গঠনকেই বোঝায়।
নেফ্রনের সংখ্যাঃ
প্রত্যেক বৃক্কে ১০ লক্ষ থেকে ১২ লক্ষ নেফ্রন আছে।প্রতিটি নেফ্রন প্রায় ৩ সে.মি. লম্বা।এ হিসেবে প্রত্যক বৃক্কের নেফ্রনের নালিকাগুলাে সম্মিলিতভাবে ৩৬কিলোমিটার(প্রায় ২২.৫ মাইল) এরও বেশি লম্বা। বৃক্কের মাধ্যমে প্রতি মিনিটে রক্ত থেকে ৫ ঘন সেমি. তরল পদার্থ পরিশ্রুত হয় কিন্তু প্রায় ৯৯% পানিই আবার রক্তে ফিরে যায়, সাধারণত প্রতি মিনিটে কেবল ১ ঘন সেমি. মূত্র সৃষ্টি হয়।
নেফ্রনের গঠনঃ ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে বােম্যান (Bowman) প্রথম নেফ্রনের গঠন বা বৃক্কের সূক্ষ্ম গঠনের সঠিক বর্ণনা দেন।
নেফ্রনের বিভিন্ন অংশঃ প্রতিটি নেফ্রনকে প্রধান ২টি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। যথা-
ক. রেনাল করপাসল (Renal corpuscle)
নেফ্রনের সম্মুখ ভাগকে রেনাল করপাসল বা মালপিজিয়ান বডি বলে। কর্টেক্স অঞ্চলে অবস্থিত এটি প্রায় ২ মি.মি. ব্যাসের একটি গােলাকার অংশ। বােম্যান্স ক্যাপসুল এবং গ্লোমেরুলাস সমন্বয়ে মালপিজিয়ান বডি নিয়ে গঠিত। রেনাল করপাসল ২টি অংশে বিভক্ত যথা-
১. বােম্যানস ক্যাপসুল
রেনাল করপাসলে গ্লোমেরুলাসের কৈশিকজালিকাগুচ্ছকে ঘিরে অবস্থিত ০.২ মি.মি ব্যাসের ও আঁইশাকার এপিথেলিয়ামে গঠিত দ্বিস্তরী পেয়ালার মতাে প্রসারিত অংশকে বােম্যানস ক্যাপসুল বলে। এর গ্লোমেরুলাস সংলগ্ন স্তরকে ভিসেরাল স্তর, বহিঃপ্রাচীরকে প্যারাইটাল স্তর এবং দুই স্তরের মাঝখানে অবস্থিত গহ্বরকে ক্যাপসুলার স্পেস বলে। ভিসেরাল স্তরটি পােডােসাইট (podocyte) নামক বিশেষ ধরনের প্রবর্ধন কোষে এবং প্যারাইটাল স্তর স্বাভাবিক আঁইশাকার এপিথেলিয়াল কোষে নির্মিত।
২. গ্লোমেরুলাস
বােম্যানস ক্যাপসুলের অভ্যন্তরে ঘনিষ্ঠভাবে গ্লোমেরুলাস অবস্থান করে। রেনাল ধমনি থেকে একটি ক্ষুদ্র অন্তর্বাহী ধমনিকা বা অ্যাফারেন্ট আর্টারিওল (afferent অ্যাফারেন্ট আর্টারিওল (arteriole) বােম্যানস ক্যাপসুলে প্রবেশ করে এবং ৫০-৬০টি কৈশিক জালিকায় বিভক্ত হয়ে গ্লোমেরুলাস গঠন করে। কৈশিকজালিকাগুলাে পুনরায় মিলিত হয়ে বহির্বাহী ধমনিকা বা ইফারেন্ট আর্টারিওল(efferent arteriorle) রূপে বােম্যানস ক্যাপসুল থেকে বেরিয়ে আসে। ইফারেন্ট আর্টারিওলের ব্যাস অ্যাফারেন্ট আর্টারিওলের চেয়ে কম হওয়ার কারণে। গ্লোমেরুলাসে সর্বদা উচ্চ রক্তচাপ বজায় থাকে।
কাজ
রেনাল করপাসল-এ রক্তের আল্ট্রাফিলট্রেশন ঘটে এবং রক্ত থেকে রেচন বর্জ্য, পানি ও অন্যান্য দ্রব্য পরিদশ্রুত হয়ে গ্লোমেরুলারস ফিলট্রেট (glumerulars filtrate) হিসেবে বােম্যানস ক্যাপসুলে জমা হয়।
খ. রেনাল টিউবিউল
রেনাল করপাসলের নিচ থেকে শুরু করে সংগ্রাহী নালিকা পর্যন্ত লম্বা নল কে রেনাল টিউবিউল বলে। এটি ৪টি অংশ নিয়ে গঠিত।যথাঃ
১. নিকটবর্তী প্যাচানাে নালিকা
বােম্যান্স (Bowmon’s) ক্যাপসুলের সাথে সংযুক্ত প্রায় ১৪ মি.মি. দীর্ঘ নালিকাকে নিটবর্তী প্যাঁচানাে নালিকা বলে। নেফ্রনের এ অংশটি বৃক্কের কর্টেক্স এ অবস্থিত। এর প্রাচীর একস্তর এপিথেলিয়াল কোষ দিয়ে গঠিত কোষগুলাের প্রান্তে অসংখ্য মাইক্রোভিলাই থাকে।
২. হেনলির লুপ
নিকটবর্তী পাচানাে নালিকার শেষ প্রান্ত সােজা হয়ে বৃক্কের মেডুলা অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং একটি U আকৃতির ফাঁস বা লুপ গঠন করে পুনরায় কর্টেক্স অঞ্চলে ফিরে আসে একে হেনলির লুপ বলে। নিম্নগামী নালিকাকে অবরােহন বাহু বলে। এ অংশে পানি পুনঃশােষণ ঘটে। U আকৃতি লুপের উর্ধ্বগামী নালিকাকে আরােহন বাহু বলে। এ অংশে Na ও Cl আয়নের পুনঃশশাষণ ঘটে।
৩. দূরবর্তী প্যাচানাে নালিকা
এটি হেনলির লুপের পরবর্তী প্যাঁচানা নালিকা। এটি ৫ মি.মি. লম্বা এবং কর্টেক্সে অবস্থান করে। এর প্রাচীর একস্তর বিশিষ্ট এপিথেলিয়াল কোষ দিয়ে গঠিত এবং শেষ প্রান্ত সংগ্রাহী নালিকার সাথে যুক্ত। এখানে পানি পুনঃশােষণ ঘটে।
৪. সংগ্রাহী নালিকা
প্রতিটি নেফ্রনের দূরবর্তী প্যাচানাে নালিকা একটি অপেক্ষাকৃত মােটা সােজা নালির সাথে যুক্ত থাকে যাকে সংগ্রাহী নালি বলে। এর প্রাচীর কিউবয়ডাল কোষ দ্বারা গঠিত। কিছু সংগ্রাহী নালি একত্রিত হয়ে বেলিনির নালি গঠন করে। অনেকগুলাে বেলিনির নালি একত্রে মেডুলার প্যাপিলারী নালীর মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত পেলভিসে উন্মুক্ত হয়। সংগ্রাহী নালি পরিত তরলকে আইসােটনিক তরলে পরিণত করে যা রক্তরসের সমতুল্য। এ নালি পরিস্রত ও পুনঃশােষিত তরল সংগ্রহ করে গবিনীতে প্রেরণ করে।
নেফ্রনের কাজঃ
১. পরিস্রাবণ (Filtration) : নেফ্রনের গ্লোমেরুলাস রক্তের প্রােটিন ছাড়া প্রায় সকল উপাদান ছাঁকনির মাধ্যমে পৃথক করে বােম্যানস ক্যাপসুলের গহ্বরে প্রেরণ করে।
২ পুনঃশােষণ (Re-absorption) : বৃক্কীয়নালিকার পরিশ্রুত তরলের প্রয়ােজনীয় পদার্থগুলাে যথা : গ্লুকোজ,অধিকাংশ লবণ এবং প্রয়ােজনীয় পানি প্রভৃতি পুনরায় শােষিত হয়ে রক্তনালিতে প্রবেশ করে।
৩. নালিকার ক্ষরণ (Tubular Secretion): বৃক্কীয় নালিকা যে শুধু পুনঃশশাষণের কাজ করে তাই নয়, এটি কয়েক ধরনের দূষিত পদার্থ, যেমন- নানা প্রকার সালফারঘটিত যৌগ, ক্রিয়েটিনিন এবং কয়েক প্রকার জৈব এসিড ইত্যাদি রক্তপ্রবাহ থেকে নালিকার গহ্বরে ক্ষরণ করে।
৪. নতুন পদার্থ সৃষ্টি (Manufacture of New Substrances) : বৃক্কীয় নালিকার এপিথেলিয় কোষে কয়েক ধরনের যৌগ, যেমন- অজৈব ফসফেট, অ্যামােনিয়া, হিপপিউরিক এসিড ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। এগুলো বৃক্কীয় নালিকার গহবরে যুক্ত হয়।
৫. ph মাত্রা নিয়ন্ত্রণ (Balancing of pl): দেহস্থিত ph এর সঠিক মাত্রা রক্ষা করে।
নেফ্রনের প্রকারভেদঃ
বৃক্কের কর্টেক্সে নেফ্রনের ম্যালপিজিয়ান বডি বা রেনাল করপাসলের অবস্থানের ভিত্তিতে মানুষের নেফ্রন তিন।
১. সুপারফিসিয়াল কর্টিকাল নেফ্রন (Superficial cortical nephrons) :
এগুলাের করপাসল বৃক্কের কর্টেক্সের বহির্ভাগের এক মিলিমিটারের মধ্যে অবস্থান করে। বৃক্কের ৮৫% নেফ্রনই এ প্রকৃতির। এগুলাের হেনলির লুপ খাটো।
২. মিড কর্টিকাল নেফ্রন (Midcortical nephrons) :
এগুলাের রেনাল করপাসল কর্টেক্সের মাঝামাঝিতে অবস্থান করে। এদের লুপ খাটো বা লম্বা হয়ে থাকে। বৃক্কের মাত্র ৫% নেফ্রন এ প্রকৃতির।
৩. জাক্সটামেডুলারি নেফ্রন (Juxtamedulary nephrons) :
এগুলাের রেনাল করপাসল কর্টেক্সের গভীরে মেডুলার সংযােগস্থলের ওপরে অবস্থান করে। এসব নেফ্রনের হেনলির লুপ অনেক লম্বা। বৃক্কের ১০% নেফ্রন এ ধরণের।
রেচনের শারীরবৃত্ত (Physiology of Excretion):
আমিষ জাতীয় খাদ্য বিপাকের ফলে দেহে নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্যপদার্থ সৃষ্টি হয়। এসব বর্জ্য দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং যতশীঘ্র সম্ভব দেহ থেকে নিষ্কাশন করা অত্যাবশ্যক। মানুষের প্রধান নাইট্রোজেনঘটিত রেচন(Excretion) বর্জ্য হলো- ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, অ্যামোনিয়া, ক্রিয়েটিনিন ইত্যাদি। এর মধ্যে ইউরিয়ার পরিমাণ সর্বাধিক এবং এটি মূত্রের সাথে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। যকৃতে ইউরিয়া উৎপন্ন হয়ে রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে বৃক্কে পৌছায়। বৃক্কে মূত্র তৈরি হয়। রেচনে এরূপ ইউরিয়ার আধিক্য থাকাকে ইউরিওটেলিজম (ureotelism) বলে। যেসব প্রাণিতে ইউরিওটেলিজম দেখা যায় তাদের ইউরিওটেলিক প্রাণি (ureotelic animal) বলা হয়। মানুষ ইউরিওটেলিক হওয়ার কারণে রেচনের শারীরবৃত্তকে (Physiology of Excretion) তাই দুটি শিরোনামে আলোচনা করা হলো :
ক. নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য উৎপাদন এবং খ. মূত্র সৃষ্টি
ক. নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য উৎপাদন (Production of Nitrogenous Waste)
আমিষ খাদ্য পরিপাক হয়ে অ্যামিনো এসিডে পরিণত হয়। অ্যামিনো এসিড প্রধানত দেহ গঠন ও বৃদ্ধির কাজে ব্যবহৃত হয়। যকৃতে অব্যবহৃত ও অতিরিক্ত অ্যামিনো এসিড থেকে ডিঅ্যামাইনেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে ডিঅ্যামিনেশন (deamination) প্রক্রিয়ায় অ্যামিনো গ্রুপ (-NH2) হয়ে কিটো এসিড ও NH2, সৃষ্টি করে। কিটো এসিড শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। অ্যামিনো গ্রুপ পরিবর্তিত হয়ে NH3 (অ্যামোনিয়া) উৎপন্ন করে।
NH3 অত্যন্ত বিষাক্ত যা CO2 এর সাথে মিলিত হয়ে যকৃতে অরনিথিন চক্রের (ornithine cycle) মাধ্যমে ক্ষতিকর ও পানিতে দ্রবণীয় ইউরিয়া (urea)-য় পরিণত হয়। এটি ইউরিয়া চক্র নামেও পরিচিত। ইউরিয়া প্লাজমায় (রক্তরসে) অবস্থান করে এবং সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে বৃক্কে পৌছায়।
খ. মূত্র সৃষ্টি (Formation of Urine):
স্কটিশ শারীরবিজ্ঞানী Arthur Robertson Cushney (1917)-র মতে, নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ রক্তের মাধ্যমে বৃক্কে আসার পর তিনটি ধাপে মূত্র সৃষ্টি হয়, যথা: (১) অতিসূক্ষ্ম পরিস্রাবণ, (২) টিউবিউলার পুনঃশোষণ এবং (৩) সক্রিয় ক্ষরণ ।
১. অতিসূক্ষ্ম পরিস্রাবণ বা আল্ট্রাফিল্ট্রেশন (Ultrafiltration)
মূত্র তৈরির প্রথম ধাপ হচ্ছে রক্তের অতিসূক্ষ্ম পরিস্রাবণ। নেফ্রনের রেনাল করপাসলে এ পদ্ধতি সংঘটিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় হৃৎপিণ্ড থেকে পৃষ্ঠীয় ধমনি, রেনাল ধমনি এবং অ্যাফারেন্ট আর্টারিওলের মাধ্যমে রক্ত অতি উচ্চ চাপে গ্লোমেরুলাসে প্রবেশ করে। সাধারণত অ্যাফারেন্ট আর্টারিওলের তুলনায় ইফারেন্ট আর্টারিওলের ব্যাস সংকীর্ণ হওয়ায় গ্লোমেরুলাসে রক্তের উচ্চ চাপ সৃষ্টি হয়। এ হাইড্রোস্ট্যাটিক চাপে রক্তের প্রোটিন ও রক্তকণিকা ছাড়া সমস্ত পানি, লবণ, শর্করা, ইউরিয়া, ইউরিক এসিড প্রভৃতি কৈশিক জালিকার এন্ডোথেলিয়াম ও ভিত্তিঝিল্লি এবং রেনাল ক্যাপসুলের এপিথেলিয়াম ভেদ করে ক্যাপসুলার স্পেস-এ জমা হয়। এ পরিস্রুত তরলকে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট বা প্রাথমিক মূত্র বলে। মানবদেহের দুটি বৃক্কের মাধ্যমে প্রতি মিনিটে প্রায় 1200 ml রক্ত প্রবাহিত হয়। এর রক্ত থেকে প্রায় 125 ml গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট বৃক্কের মাধ্যমে বোম্যানস ক্যাপসুল-এ জমা হয়।
অন্যদিকে পরিস্রুত রক্ত পরে ইফারেন্ট আর্টারিওলে প্রবেশ করে। যে চাপের মাধ্যমে রক্তের দ্রাব্য বস্তু পরিস্রুত হয়, তাকে বলে কার্যকর পরিস্রাবণ চাপ (effective filtration pressure)। পরিস্রাবণ প্রক্রিয়াটি চাপ প্রয়োগের ফলে সংঘটিত হয় বলে একে আল্ট্রাফিল্ট্রেশন বলা হয় । হিসেবে দেখা গেছে, কার্যকর পরিস্রাবণ চাপ ২৫ mmHg। এ চাপের প্রভাবে প্রতি মিনিটে প্রায় ১২৫ ml রক্তরস গ্লোমেরুলাস থেকে পরিস্রুত হয়। তবে এ হার পরিস্রাবণ চাপের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।
২. টিউবিউলার পুনঃশোষণ বা নির্বাচিত পুনঃশোষণ (Tubular reabsorption or Selective reabsorption) :
বোম্যানস ক্যাপসুল থেকে গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেট বৃক্ক নালিকা বা রেনাল টিউবিউলে প্রবেশ করে। এখানে গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেট ৮০% নির্বাচিত পদার্থ পুনঃশোষিত হয়ে রক্তে প্রবেশ করে। টিউবিউলের প্রাচীরের কোষগুলো পুনঃশোষণের জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত। যেমন- কোষগুলোর একপাশে মাইক্রোভিলাই ও বেসাল চ্যানেল থাকায় এদের শোষণতল বেশি সাইটোপ্লাজমে বেশি সংখ্যক মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে। রক্তের কৈশিক জালিকার সাথে ঘন সন্নিবিষ্ট থাকে। রেনাল টিউবিউলসের বিভিন্ন অংশে যেসব পদার্থের পুনঃশোষণ হয় তা হলো –
প্রক্সিমাল বা নিকটবর্তী প্যাঁচানো নালিকা (Proximal convoluted tubule) : এখানে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেটের ৬০% পুনঃশোষিত হয়। গ্লুকোজ, অ্যামিনো এসিড, ভিটামিন, হরমোন, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্লোরাইড, ফসফেট, বাইকার্বোনেট, পানি, কিছু ইউরিয়া ইত্যাদি এ অংশে পুনঃশোষিত হয়।
নেফ্রন এ মূত্র সৃষ্টি কৌশলঃ
হেনরির লুপ (Loop of Henle) : এখানে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, হাইড্রোজেন, ক্লোরিন আয়ন ইত্যাদি পুনঃশোষিত হয়। অন্যদিকে ADH (অ্যান্টি ডাইইউরেটিক হরমোন) পানি পুনঃশোষণে সাহায্য করে।
ডিস্টাল বা দূরবর্তী প্যাঁচানো নালিকা (Distal convoluted tubule) : এখানে পটাসিয়াম, হাইড্রোজেন, ক্লোরিন আয়ন ইত্যাদি যত হয়। অন্যদিকে ADH (অ্যান্টি ডাইইউরেটিক হরমোন) পানি পুনঃশোষণে সাহায্য করে।
সংগ্রাহী নালি (Collecting Duct) : এখানে প্রধানত পানি এবং অল্প Cl–, Na+ ও ইউরিয়া পুনঃশোষিত হয়।
৩. টিউবিউলার ক্ষরণ বা সক্রিয় ক্ষরণ (Tubular or Active secretion) :
বিপাক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট কিছু অপ্রয়োজনীয় উপজাত পদার্থ, যথা- ক্রিয়েটিনিন ও কিছু ইউরিয়া প্রক্সিমাল প্যাঁচানো নালিকার চারপাশে রক্তজালক থেকে সক্রিয় ক্ষরণের মাধ্যমে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেটের সাথে যুক্ত হয়। ডিস্টাল প্যাঁচানো নালিকায় হাইড্রোজেন আয়ন, পটাসিয়াম ও অ্যামোনিয়াম আয়ন, সেরেটোনিন, কোলিন, হিস্টামিন ইত্যাদি ক্ষরিত হয়ে ফিলট্রেটের সাথে মিশে মূত্রে (urine) পরিণত হয়। উৎপন্ন মূত্র অতঃপর সংগ্রাহী নালিকা, ইউরেটার হয়ে মূত্রথলি থেকে মূত্রনালির মাধ্যমে বাইরে নিষ্কাশিত হয়।
মূত্র বা নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের গতিপথ নিচে দেখানো হলো :
হৃৎপিণ্ড → অ্যাওর্টা → পৃষ্ঠীয় মহাধমনি → রেনাল ধমনি → অ্যাফারেন্ট আর্টারিওল → গ্লোমেরুলাস → বোম্যানস ক্যাপসুলের গহ্বর → রেনাল টিউবিউলস → সংগ্রাহী নালি → বৃক্কের পেলভিস → ইউরেটার → মূত্রথলি → মূত্রনালি → রেচন ছিদ্র → দেহের বাইরে নিষ্কাশন।
মূত্র (Urine):
নেফ্রনের রেনাল টিউবিউলসে গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেটের নির্বাচিত পুনঃশোষণের পর যে খড় বর্ণের, তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধযুক্ত ও অম্লধর্মী তরল রেচন(Excretion) বর্জ্য মূত্রথলিতে জমা হয় তাকে মূত্র বলে। একজন সুস্থ মানুষ দৈনিক গড়ে ১.৫ লিটার মূত্রের মূত্র ত্যাগ করে। তবে কিছু কারণে এ পরিমাণ প্রভাবিত হয়ে থাকে। যেমন- খাদ্যে তরল পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকলে মূত্রের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ও শরীরে ঘাম বেশি হলে মূত্রের পরিমাণ কমে যায়। খাদ্যের প্রকৃতিও অনেক সময় মূত্রের পরিমাণের পার্থক্য ঘটায়। লবণাক্ত খাদ্য সাধারণত মূত্রের পরিমাণ বাড়ায়। বহুমূত্র (diabetes), বৃক্ক প্রদাহ (nephritis) প্রভৃতি রোগ প্রস্রাবের হার ও মাত্রা উভয়কে প্রভাবিত করে। কিছু দ্রব্য মূত্রের স্বাভাবিক প্রবাহকে বাড়িয়ে দেয়। এসব দ্রব্য ডাইইউরেটিকস (diuretics) বা মূত্রবর্ধক নামে পরিচিত । পানি, লবণাক্ত পানি, চা ও কফি এ ধরনের দ্রব্য।
মূত্রের বৈশিষ্ট্য (Properties of Urine) :
পরিমাণ : প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের বৃক্কে দৈনিক ০.৫ থেকে ২.৫ লিটার মূত্র উৎপন্ন হয়।
বর্ণ : মূত্রে ইউরোক্রোম নামক রঞ্জক পদার্থ থাকায় এটি খড় (হালকা হলুদ) বর্ণের হয়।
গন্ধ : মূত্রের গন্ধ অনেকটা ঝাঁঝালো। দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ ইউরিনোড (C6H8O)- এর উপস্থিতির জন্য মূত্রে এরূপ গন্ধ হয়।
রাসায়নিক ধর্ম : মূত্র সামান্য অম্লীয়। এর pH মান ৫.০ – ৬.৫।
আপেক্ষিক গুরুত্ব : মূত্রের স্বাভাবিক আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.০০৮ – ১.০৩০।
মূত্রের উপাদান (Urine components) :
মূত্রের রাসায়নিক উপাদানের মধ্যে ৯৫% (৯৫-৯৭%) পানি এবং ৫% এর মধ্যে জৈব ও অজৈব উপাদান রয়েছে। এর মধ্যে সামান্য পরিমাণে আয়োডিন, সিসা, আর্সেকনিক প্রভৃতি পাওয়া যায়।
মূত্রে যেসব উপাদান পাওয়া যায় সেগুলো হলোঃ
উপাদান | শতকরা হার |
---|---|
পানি | ৯৫ |
ইউরিয়া | ২ |
ইউরিক এসিড | ০.০৫ |
ক্রিয়েটিনিন | ০.০৭৫ |
সোডিয়াম | ০.৩৫ |
অ্যামোনিয়াম | ০.০৪ |
পটাসিয়াম | ০.১৫ |
ম্যাগনেসিয়াম | ০.০১ |
ক্লোরাইড | ০.৬০ |
সালফেট | ০.১৮ |
ফসফেট | ০.২৭ |
অন্যান্য | ১.২৭৫ |
রেচন ও অসমোরেগুলেশনে বৃক্কের ভূমিকা (Role of Kidney in Excretion and Osmoregulation):
কোষ থেকে নাইট্রোজেনঘটিত বিপাকীয় বর্জ্যের অপসারণের আরেক নাম রেচন(Excretion)। বিপাকীয় বর্জ্য দেহের জন্য অপ্রয়োজনীয়। দেহকোষ, টিস্যু ও অঙ্গে যে অসংখ্য রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে তার ফলে দেহের জন্য ক্ষতিকর যেসব বিষাক্ত পদার্থ উৎপন্ন হয় তা রেচনে এবং দেহের অসমোরেগুলেশনে (রক্তে পানি ও আয়নসাম্য রক্ষা) বৃক্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রেচনে বৃক্কের ভূমিকা (Role of Kidney in Excretion):
বৃক্ক প্রধানত নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য পদার্থ দেহ থেকে নিষ্কাশন করে । আমিষ জাতীয় খাদ্য বিপাকের ফলে দেহে নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য সৃষ্টি হয়। অ্যামোনিয়া, ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, ক্রিয়েটিনিন ইত্যাদি মানুষের প্রধান নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য। এদের রেচন(Excretion) বর্জ্য বলে। এগুলো রক্তের মাধ্যমে সারাদেহে প্রবাহিত হয়। এগুলো বিষাক্ত ও দেহের জন্য ক্ষতিকর। তাই এসব রেচন পদার্থ দেহ থেকে নিষ্কাশন করা অত্যাবশ্যক। বৃক্ক এসব রেচন পদার্থ দেহ থেকে অপসারণ করে দেহকে সুস্থ রাখে । নিম্নলিখিত উপায়ে বৃক্ক এসব বর্জ্য নিষ্কাশন করে।
ইউরিয়া বর্জ্য : আমিষ জাতীয় খাদ্য পরিপাক হয়ে অ্যামিনো এসিডে পরিণত হয়। অ্যামিনো এসিড প্রধানত দেহ গঠন ও বৃদ্ধির কাজ করে থাকে। অ্যামিনো এসিডের বৈশিষ্ট্য হলো দেহে যতটুকু অ্যামিনো এসিড প্রয়ােজন ঠিক ততটুকুই ব্যবহৃত হতে পারে, অতিরিক্ত অ্যামিনো এসিড দেহে সঞ্চিত থাকতে পারে না। অতিরিক্ত অ্যামিনো এসিড যকৃতে ডি-অ্যামাইনেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে ডি-অ্যামিনেশন (deamination) প্রক্রিয়ায় কিটো এসিড ও অ্যামিন মূলক (C, NH) সৃষ্টি করে। কিটো এসিড শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় এবং অ্যামিন মূলক (NH) হাইড্রোজেন আয়ন (H+) এর সাথে যুক্ত হয়ে অ্যামোনিয়া (NH3) সৃষ্টি করে। অ্যামোনিয়া (NH3) অত্যন্ত বিষাক্ত। এটি (CO2) এর সাথে যুক্ত হয়ে যকৃতে অরনিথিন চক্রের মাধ্যমে কম ক্ষতিকারক পানিতে দ্রবণীয় ইউরিয়াতে পরিণত হয়। ইউরিয়া রক্তের প্লাজমায় অবস্থান করে এবং সংবহন তন্ত্রের মাধ্যমে বৃক্কে পৌছে। এরপর মূত্র সৃষ্টির মাধ্যমে দেহ থেকে বহিষ্কৃত হয়।
ইউরিক এসিড বর্জ্য : যকৃতের কোষে নিউক্লিক এসিডের পিউরিন ক্ষারক বিপাকের ফলে ইউরিক এসিড সষ্টি হয়। এটি ইউরিয়া অপেক্ষা কম বিষাক্ত। ইউরিক এসিড রক্তের মাধ্যমে বৃক্কে পৌঁছে এবং দেহ থেকে বহিষ্কৃত হয়।
ক্রিয়েটিনিন বর্জ্য : দেহের পেশিতে অবস্থিত ক্রিয়েটিন (creatine) নামক অ্যামিনো এসিডের বিপাকের ফলে ক্রিয়েটিনিন বর্জ্য সৃষ্টি হয়। দেহে বিদ্যমান প্রায় ২% ক্রিয়েটিন বিপাক প্রক্রিয়ায় পেশিতে শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় এবং ক্রিয়েটিনিন সৃষ্টি করে। ক্রিয়েটিনিন রক্তের মাধ্যমে বৃক্কে পৌছে। বৃক্কে রক্ত থেকে ক্রিয়েটিনিন পরিস্রুত হয়ে মুত্রের সাথে দেহ থেকে বের হয়ে যায়। রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা দ্বারা বৃক্কের সুস্থতা নির্ণয় করা হয়। তাই রক্তের ক্রিয়েটিনিন মাত্রাকে বৃক্কের রোগ নির্ণয়ের নির্দেশক (diagnostic index of kidney) হিসেবে গণ্য করা হয়। রক্তে ক্রিয়েটিনিনের স্বাভাবিক মাত্রা পুরুষের 0.6 – 1.2 mg/dl এবং মহিলাদের 0.5 – 1.1 mg/dl. বৃক্কের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষ, অতিরিক্ত ঔষধ, হরমোন ইত্যাদিও মূত্রের সাথে বহিষ্কৃত হয়।
অসমোরেগুলেশনে বৃক্কের ভূমিকা (Role of Kidney in Osmoregulation)
অসমোরেগুলেশন প্রক্রিয়া বলতে জীবন্ত কোষ বা দেহের অন্তঃ ও বহিঃপরিবেশের মধ্যে তা সমতা রক্ষাকে বুঝায়। দেহের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের স্থিতি বজায় রাখতে (homeostasis) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেহের পানি ও সোডিয়াম, পটাসিয়াম লবণ এবং ক্লোরাইড আয়নের মধ্যে একটি আন্তরসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়াকে অসমোরেগুলেশন বলা হয়।
অসমোরেগুলেশন পদ্ধতি (Osmoregulation system) :
দেহে পানির সমতা রক্ষা করার জন্যে অ্যান্টিডাইইউরেটিক হরমোন (Antidiuretic Hormone, ADH) নামক একটি হরমোন রয়েছে । ADH-কে ভ্যাসোপ্রেসিন (vasopressin)-ও বলা হয়। দেহের পানির পরিমাণ কম হলে রক্তে ADH এর পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে বৃক্ক অল্প পরিমাণ (মিনিটে ০.৫ মিলিলিটার), মূত্র উৎপন্ন করে এবং দেহের পানির পরিমাণ ঠিক রাখে।
অন্যদিকে কোন কারণে পানির আধিক্য দেখা দিলে রক্তে ADH অতিমাত্রায় কমে যায় এবং দেহের পানির পরিমাণ বেড়ে যায় কারণ বৃক্কে পানি শোষণের ক্ষমতা কমে যায়। এ অবস্থায় মূত্রের পরিমাণ প্রতি মিনিটে ১৬ মিলিলিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। মস্তিষ্কের গোড়ায় হাইপোথ্যালামাস অংশে কিছু স্নায়ুকোষ এ ADH ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এখান থেকে নিউরোসিক্রেশন (neurosecretion) পদ্ধতির মাধ্যমে নিঃসৃত ADH পশ্চাৎ পিটুইটারি গ্রন্থির মধ্যে পরিবাহিত হয় এবং রক্তে অবমুক্ত হয়। হাইপোথ্যালামাসের মধ্যে উপস্থিত অসমোরিসেপ্টর (osmoreceptor) নামক স্নায়ুকোষ দেহ তরলের অভিস্রবণিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
বৃক্কের তাৎক্ষণিক বিকলঃ
বয়স বাড়ার সাথে সাথে বৃক্কের কাজকর্মেও (বিশেষ করে পরিস্রাবণ প্রক্রিয়ায়) পরিবর্তন ঘটে, সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসে। বলা হয়ে থাকে, ৭০ বছর বয়স্ক মানুষের বৃক্ক মাত্র ৫০% কাজে সক্ষম থাকে। রোগ-ব্যাধির কারণে বৃক্কের সক্ষমতা কমে যাওয়াকে বৃক্ক বিকল (kidney failure) বলে। বৃক্কের বৈকল্য (kidney failure) দু’ভাবে দেখা দিতে পারে, একটি হচ্ছে দীর্ঘক্ষণিক (chronic), অন্যটি তাৎক্ষণিক (acute)।
বৃক্কের বৈকল্য ঘটতে যদি কয়েক বছর লেগে যায় (অর্থাৎ ধীরে ধীরে বিকল হতে থাকে) তখন তা দীর্ঘক্ষণিক বিকল। অন্যদিকে, মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে যখন বৃক্ক দেহের বর্জ্যপদার্থ অপসারণে, পানি ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে অক্ষম হয়ে পড়ে তখন বৃক্কের এ অবস্থাকে বৃক্কের তাৎক্ষণিক বিকল বলে।
বৃক্কের তাৎক্ষণিক বিকলের কারণ (Causes of Acute Kidney Failure)
*ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা)
*বড় কোনো ক্ষত থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে বৃক্কে রক্ত প্রবাহ কমে গেলে
*অতিমাত্রায় ডায়ারিয়া ও বমির কারণে
শক (টিস্যুতে কম রক্ত সরবরাহ), হার্ট অ্যাটাক, অ্যাকিউট পানক্রিয়াটাইটিস (অগ্ন্যাশয়য়ের প্রদাহ), ভুল রক্ত দেয়ার জন্য, মারাত্মক অগ্নিদগ্ধ হওয়ায়, রক্ত প্রবাহ কমে গেলে
*বৃক্কে পাথর, মূত্রনালিতে টিউমার বা জন্মগত ত্রুটি থাকলে, পুরুষে প্রোস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে গেলে
*অতি মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক (যেমন- জেন্টামাইসিন, স্ট্রেপ্টোমাইসিন), ব্যাথানাশক ঔষধ (যেমন- অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন), উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ (যেমন- এসিই ইনহিবিটর) সেবনে
*বিষাক্ত পদার্থ, যেমন- কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, আর্সেনিক, লেড, মার্কারি ইত্যাদি গ্রহণে
বৃক্কের টিস্যু ও পরিস্রাবক এককগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে
বৃক্কের বিকলের লক্ষণ (Symptoms of Acute Kidney Failure)
*অতি অল্প, ঘন ও গাঢ় মূত্র ত্যাগ বা মূত্র একেবারেই না হওয়া
*রক্তে নাইট্রোজেনজাত বর্জ্যপদার্থ সঞ্চিত হওয়া
শরীর ফুলে যাওয়া (অতিরিক্ত পানি দেহে জমে যাওয়ায়)
*পাঁজর ও কোমরের মাঝামাঝি দুপাশে ব্যথা (flank pain)
*ক্ষুধামন্দা, বমি-বমি ভাব ও বমি করা
উচ্চ রক্তচাপ
রক্ত পায়খানা
*হাত-পায়ে সংবেদ কমে যাওয়া
*অর্নেকক্ষণ ধরে/হেঁচকি তোলা
ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া
প্রতিকার (Measures)
উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
যে পরিমাণ প্রস্রাব হয় সে পরিমাণ পানির সাথে অতিরিক্ত ৫০০ মি.লি. পানি তাকে খেতে দিতে হবে।
প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি দেয়া যাবে না।
দেহে দেহরস ও ইলেকট্রোলাইট এর ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
পঞ্চাশোর্ধ বয়সে নিজের বা পরিবারের অন্য কারো ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তাদের বৃক্ক নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে।
ডায়ালাইসিস (Dialysis)
একটি বৈষম্যভেদ্য ঝিল্লির ভিতর দিয়ে নির্বাচনমূলক ব্যাপন প্রক্রিয়ায় কোনো দ্রবণের কলা দ্রবীভূত পদার্থের পৃথকীকরণকে ডায়ালাইসিস (Dialysis) বলে। ডায়ালাইসিস দুধরনের-
হিমোডায়ালাইসিস (Haemodialysis)
পেরিটোনিয়াল (Peritoneal dialysis)
ক. হিমোডায়ালাইসিস (Haemodialysis) : এ প্রক্রিয়ার শুরুতে কিছু যন্ত্রপাতি, দ্রবণ ও টিউবের সমন্বয়ে একটি কৃত্রিম বৃক্ক ডায়ালাইজারে, নির্মাণ করা হয়। কৃত্রিম বৃক্ক আসল রক্ত পরিশোধিত বৃক্কের মতো একই নীতি অনুসরণ করে কাজ করে। সংক্ষেপে বলতে গেলে রক্তকে পাম্প করে শরীর থেকে ডায়ালাইসিস বের করে বর্জ্যপদার্থ অপসারণের উদ্দেশে পরিস্রুত করে যেভাবে আবার দেহে ফেরত পাঠানো হয় তাকে হিমোডায়ালাইসিস বলে ।
হিমোডায়ালাইসিস প্রক্রিয়ার শুরুতে রোগীর দেহে একটি ধমনির ভিতর ফাঁপা নলাকার সূচ ঢোকানো হয়। এর নাম ক্যাথেটার (catheter)। এটি পিছন দিকে একটি নমনীয় টিউবের সাথে লাগানো থাকে। টিউবটি প্রথমে কিডনি মেশিনের সঙ্গে যুক্ত হয়, পরে একটি শিরায় এসে মিলিত হয়। বাহুর নিমপ্রান্ত বা পায়ে ক্যাথেটার লাগানো হয়। যাদের ঘন ঘন ডায়ালাইসিস হয় তাদের ক্ষেত্রে একটি ছোট টিউবসহ ক্যাথেটারটি স্থায়ীভাবে লাগিয়ে রাখা হয়। পাম্পের সাহায্যে সযত্নে ধমনি থেকে রক্ত বের করে শিরার দিকে চালনা করা হয়। রক্তে হেপারিন (heparin) মেশানো হয় যাতে জমাট না বাঁধে। রক্ত ধীরে ধীরে কিডনি মেশিনের ডায়ালাইসিস দ্রবণ বা ডায়ালাইসেট (dialysate)-এ শায়িত টিউবের ভিতর দিয়ে সংবহিত হয়। টিউবগুলো কৃত্রিম আংশিক ভেদ্য (partially permeable) ঝিল্লি-নির্মিত যা ব্যাপন প্রক্রিয়ায় অতিক্ষুদ্র অণু ও পানিকে ব্যাপিত হওয়ার সুযোগ দেয়। রক্তকণিকা ও প্রোটিন অণু বড় হওয়ায় ব্যাপিত হতে পারে না। রক্ত ও ডায়ালাইসেট (ডায়ালাইসিস দ্রবণ)-এর মধ্যে সমতা না আসা পর্যন্ত বিনিময় অব্যাহত থাকে। রক্তের অবাঞ্ছিত বস্তু, বিশেষ করে ইউরিয়া ও অতিরিক্ত সোডিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি অপসারিত হয়, প্রয়োজনীয় বস্তু থেকে যায়। প্রতি সপ্তাহে রোগীকে দুবার হিমোডায়ালাইসিসের সম্মুখীন হতে হয়। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে ৪-৫ ঘন্টা সময় লাগে। প্রতিবার সদ্য বানানো ডায়ালাইসেট ব্যবহার করতে হয়।
ডায়ালাইসেটের উপাদান : হিমোডায়ালাইসিসের উদ্দেশ্যে ডায়ালাইসিস টিউবগুলোকে ডায়ালাইসেট বলে। এর উপাদনগুলো হচ্ছে- সঠিক তাপমাত্রা (স্থির দেহ তাপমাত্রা); সঠিক আয়নিক ভারসাম্য, বিশেষ করে Na+, K+, Cl–, Mg2+, Ca2+ ও HCO3– (এসিটেট রূপে); অতিরিক্ত পুষ্টি, যেমন গ্লুকোজ; সঠিক pH ও বাফারিং ক্ষমতা (buffering capacity) ইত্যাদি।
খ. পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস (Peritoneal dialysis) : কৃত্রিম ঝিল্লির পরিবর্তে দেহে অবস্থিত পেরিটোনিয়াল ঝিল্লি (পেরিটোনিয়াম)-কে ডায়ালাইসিং ঝিল্লি হিসেবে ব্যবহার করে বৃক্কের ডায়ালাইসিস প্রক্রিয়াকে পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস বলে। এ প্রক্রিয়ার শুরুতে রোগীর উদর প্রাচীরে একটি ছোট চেরাছিদ্র করে তার ভিতর দিয়ে
পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস প্রক্রিয়া শুরুতে প্লাস্টিক টিউব উদরীয় গহ্বরে প্রবেশ করানো ও স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়া হয়। উদরীয় গহ্বরের প্রাচীরটি পেরিটোনিয়াম যা আংশিক ভেদ্য এবং ডায়ালাইসিং ঝিল্লি হিসেবে কাজ করে। প্লাস্টিক টিউবের ভিতর দিয়ে ডায়ালাইসেট উদরীয় গহ্বরে প্রবেশ করিয়ে কয়েক ঘন্টা রেখে দেয়া হয়। ডায়ালাইসেট ও উদরের বাকি অংশের টিস্যু-তরলের মধ্যে উপাদানের বিনিময় ঘটে। দিনে ৩-৪ বার ডায়ালাইসেট প্রতিস্থাপন করা যায়।
বৃক্ক প্রতিস্থাপন (Kidney Transplant):
বৃক্ক বিকলের দীর্ঘকালীন সমাধানে রোগীর দেহে ভিন্ন ব্যক্তির সুস্থ ও সঠিক বৃক্ক অস্থাপনকে বৃক্ক স্থাপনকে বৃক্ক প্রতিস্থাপন বলে। বৃক্ক বিকলের চিকিৎসায় ডায়ালাইসিস পদ্ধতি সাময়িক সমাধান হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যয় সাপেক্ষ মনে হলেও দীর্ঘকালীন হিসেবে বৃক্ক প্রতিস্থাপনই ভালো পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। স্থায়ীভাবে নষ্ট বৃক্কের বিকল্প হিসেবে একটি সুস্থ বৃক্ক প্রতিস্থাপনই স্থায়ী সমাধান হতে পারে।
বৃক্ক প্রতিস্থাপনে অবশ্য স্মরণীয় বিষয় হচ্ছে –
বৃক্কদাতা (অনাত্মীয় বা আত্মীয়) যেই হোক না কেন তার দেহ থেকে সংগ্রহের ঠিক ৪৮ ঘন্টার মধ্যে রোগীর দেহে স্থাপন করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে যতখানি সময় বৃক্কটি বাইরে থাকে ততক্ষণ বৃকের উপর দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে স্যালাইন দ্রবণ প্রবাহিত করা হয়। দাতা মৃত হলে সদ্যমৃত দাতার দেহ থেকে বৃক্ক সগ্রহ করতে হবে।
সংগৃহীত বন্ধুটি সুস্থ হতে হবে (HIV বা অন্যান্য সংক্রমণমুক্ত হতে হবে)।
বৃক্কদাতা ও গ্রহীতার ব্লাড গ্রুপ এবং টিস্যুর ধরণ এক হতে হবে।
বৃক্ক প্রতিস্থাপনের সময় প্রথমে গ্রহীতার শ্রোণিদেশে অপারেশনের মাধ্যমে দাতাবৃক্কটিকে স্থাপন করা হয়। দাতাবৃক্কের ধমনি ও শিরাকে গ্রহীতার ধমনি ও শিরার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। নতুন বৃক্কের ইউরেটারকে পৃথকভাবে মূত্রথলির সাথে জুড়ে দেয়া হয়। এভাবে বৃক্কের প্রতিস্থাপন ঘটে।
মানবদেহে হরমোনাল ক্রিয়া (Hormonal Activities):
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি শারীরবিজ্ঞানী ক্লড বার্নার্ড (Claude Bernard) সর্বপ্রথম প্রাণিদেহের অন্তঃস্থ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার কৌশলের উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে মানবদেহে মূত্রের ঘনত্ব, রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা ও রক্তের pH নিয়ন্ত্রণে মূল কার্যকর উপাদান হিসেবে হরমোনাল ক্রিয়া (Hormonal Activities) কিভাবে জটিল ও সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে চলেছে বিজ্ঞানীরা তা উদ্ভাবন করেছেন। নিচে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো :
মূত্রের ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ (Control of Urine Concentration):
আহারের সঙ্গে পানি গ্রহণ এবং ঘাম, মল-মূত্র ত্যাগ ইত্যাদির মাধ্যমে পানি ত্যাগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহ রক্তের দ্রব (solute)-এর স্থিতাবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। এ প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্টৰ্ভাবে প্রভাব ফেলে অ্যান্টিডাইইউরেটিক হরমোন (ADH)। বিপুল পরিমাণ কম ঘন মূত্র উৎপাদন প্রক্রিয়া ডাইইউরেসিস (diuresis) এবং এর বিপরীত প্রক্রিয়াটি অ্যান্টিডাইইউরেসিস (antidiuresis) নামে পরিচিত। ADH কার্যগতভাবে অ্যান্টিডাইউরেটিক, অতএব বেশি ঘন মূত্র উৎপন্নে ভূমিকা পালন করে। ADH একটি পেপটাইড হরমোন। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে উৎপন্ন হয়ে পিটুইটারি গ্রন্থির পশ্চাৎখন্ডে প্রবেশ করে। রক্তে পানির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে অবস্থিত অসমোরিসেপ্টর কোষগুলো উত্তেজিত হয় এবং ADH উৎপন্ন করে । নিউরোনের অ্যাক্সন বেয়ে ADH পশ্চাৎ পিটুইটারি গ্রন্থিতে প্রবেশ করে এবং রক্তস্রোতে ক্ষরিত হয়। ক্ষরিত হরমোন বৃক্কসহ দেহের সব অংশে বাহিত হয়। বৃক্কে নেফ্রনগুলোর সংগ্রাহী নালির কোষঝিল্লিতে অবস্থিত গ্রাহক অণু ADH গ্রহণ করে, ফলে ঝিল্লির পানিভেদ্যতা বেড়ে যায়। গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট থেকে তখন পানি অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় বৃক্কের সংগ্রাহী নালিতে পুনঃশোষিত হয়। সংগ্রাহী নালিতে তরল বেশ ঘন হয়ে যায় এবং ব্যক্তি অল্প পরিমাণ অতিঘন মূত্র উৎপন্ন করে। অন্যদিকে, রক্তে পানির পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেলে হাইপোথ্যালামাসের অসমোরিসেপ্টর কোষগুলো তেমন উত্তেজিত হয় না এবং অতি অল্প পরিমাণ ADH ক্ষরিত হয়। তখন সংগ্রাহী নালির কোষগুলো প্রায় পানি-অভেদ্য হয়ে যায়, ফলে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেট থেকে পানি পুনঃশোষণ বন্ধ থাকে।
সংগ্রাহী নালিতে তখন ফিলট্রেট অনেক তরল হয়ে যায় এবং ব্যক্তি বেশি পরিমাণ অতি তরল মূত্র উৎপন্ন করে। দেহে পানির সমতা ফিরে না আসা পর্যন্ত এ অবস্থা হত থাকে। রেনাল ক্যাপসুলে পারস্রাবণ প্রক্রিয়া সবসময় অব্যাহত থাকে। পানির অভাবে রক্তরসের গাঢ়তা বাড়লে কিংবা কমে গেলে অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে ক্ষরিত অ্যালডোস্টেরন (aldosterone) হরমোন মূত্রে সোডিয়াম আয়নের রেচন কমিয়ে পরোক্ষভাবে পানির রেচনও হ্রাস করে।
রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ (Control of Sodium in Blood):
রক্তের প্লাজমায় সোডিয়ামের মাত্রা স্থির রাখতে যে হরমোনটি নিয়ন্ত্রন নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে সেটি হচ্ছে অ্যালডোস্টেরন (aldosterone)। এ হরমোনও পানি পুনঃশোষণকে প্রভাবিত করে অ্যালডোস্টেরন ক্ষরিত হয় অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির কর্টেক্স (বহিঃস্থ অঞ্চল থেকে)। রক্তে সোডিয়াম কম হলে অভিস্রবণের মাধ্যমে কম পানি প্রবেশ করে, তাই রক্তের আয়তন কমে যায়। এর ফলে রক্তচাপও হ্রাস পায়। চাপ ও আয়তন হ্রাস পেলে ডিস্টাল বা দূরবর্তী নালি ও অ্যাফারেন্ট ধমনিকার (afferent arteriole) মাঝখানে অবস্থিত জাক্সটাগ্লোমেরুলার কমপ্লেক্স নামে একগুচ্ছ সংবেদী কোষ উদ্দীপ্ত হয় এবং রেনিন (renin) এনজাইম ক্ষরণ করে।
যকৃত থেকে উৎপন্ন ও প্লাজমায় অবস্থিত একধরনের প্রোটিনকে রেনিন সক্রিয় অ্যানজিওটেনসিন (angeotensin) হরমোনে পরিণত করে। ঐ হরমোন অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে অ্যালডোস্টেরন ক্ষরণকে উদ্দীপ্ত করে। অ্যালডোস্টেরন রক্তবাহিত হয়ে বৃক্কের ডিস্টাল প্যাঁচানো নালিকায় পৌছায় এবং নালিকার কোষগুলোতে সোডিয়াম-পটাসিয়াম পাম্প (sodium-potassium pump)-কে উদ্দীপ্ত করে। ফলে দূরবর্তী প্যাঁচানো নালিকা থেকে সোডিয়াম আয়ন বেরিয়ে নালিকার চারপাশের কৈশিকজালিকায় প্রবেশ কলে। অন্যদিকে, পটাসিয়াম আয়ন প্রবেশ করে কৈশিকজালিকা থেকে দূরবর্তী প্যাচানো নালিকায়। অ্যালডেস্টেরন অস্ত্রে সোডিয়াম শোষণকে এবং ঘামে কম সোডিয়াম ত্যাগকে উদ্দিীপ্ত করে। এ দুই প্রক্রিয়ার ফলে রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়। এ কারণে অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় রক্তে প্রচুর পানি প্রবেশ করে তাই রক্তের আয়তন ও চাপ উভয়ই বেড়ে যায়।
রক্তের pH নিয়ন্ত্রণ (Control of Blood pH):
পিএইচ (pH) হচ্ছে হাইড্রোজেন আয়ন ঘনত্বের একটি পরিমাপক। নিরপেক্ষ pH হচ্ছে 7.0, এসিড pH হয় 7-এর নিচে আর ক্ষারীয় pH হছে 7-এর উপরে। কিছু রাসায়নিক পদার্থ দ্রবণে pH-এর পরিবর্তনকে প্রতিহত করতে সক্ষম। এসব পদার্থকে বলে বাফার (buffers)। রক্তের প্লাজমার স্বাভাবিক pH হচ্ছে 7.4। এ মাত্রা যথাসম্ভব বজায় না রাখলে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। দেহে ক্ষারের চেয়ে বেশি এসিড বেশি উৎপন্ন হয়। অতএব, এসিডিটি কমানোর বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী।এসিডিটি বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হচ্ছে কোষীয় শ্বসনে উৎপন্ন CO2। এটি দ্রবীভূত হয়ে H2CO3 (কার্বনিক এসিড) নামে একটি দুর্বল এসিডে পরিণত হয়। এটি ভেঙ্গে H+ ও H2CO3 (হাইড্রোজেন কার্বনেট আয়ন) উৎপন্ন হয়। CO2 এর ঘনত্ব বেশি হয়ে গেলে পরিত্রাণ পেতে প্রতিবর্ত সাড়া হিসেবে শ্বাসপ্রশ্বাসের হার বেড়ে যায় । HCO3– বাফার হিসেবে কাজ করতে পারে কারণ H+ এর ঘনত্ব বেশি হয়ে গেলে এগুলো H2CO3 গঠন করে । রক্তে HCO3– ও ফসফেট বাফার অতিরিক্ত H+ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এ কারণে রক্তের pH কমে না। প্লাজমার স্বাভাবিক pH এ যেন পরিবর্তন না ঘটে সে উদ্দেশে নেফ্রনের নিকটবর্তী ও দূরবর্তী প্যাঁচানো নালিকা এবং সংগ্রাহী নালি নিম্নোক্ত দু’ভাবে কাজ করে-
রক্ত অতিএসিডিক হতে শুরু করলে দূরবর্তী নালিকা ও সংগ্রাহী নালির কোষগুলোর সাহায্যে রক্ত থেকে H+ সক্রিয় পরিবহন (active transport)-এর মাধ্যমে নালিকাতে পরিবাহিত হয়। CO2 যদি H+ এর উৎস হয়ে থাকে তাহলে HCO3– ও উৎপন্ন হয়ে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় রক্তে ফেরত যাবে । pH বেড়ে গেলে বিপরীত ঘটনা ঘটবে। এসব পরিবর্তনের কারণে মূত্রের pH 4.5-8.5 পর্যন্ত হতে পারে।
pH কমে গেলেও বৃক্ককোষে অ্যামোনিয়াম বেইস (base) আয়ন (NH4+) সৃষ্টিতে উদ্দীপ্ত হয়। NH+ এসিডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৃক্কে বাহিত হয় এবং অ্যামোনিয়াম লবণ হিসেবে রেচিত হয়।
6.0 - 6.3
6.4 - 7.2
6.8 - 7.2
7.35-7.45
Read more